no fucking license
Bookmark

ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫ : সুপ্রিম কোর্ট কোন ধারা স্থগিত করেছে, আর কোনটি করেনি

সুপ্রিম কোর্ট সোমবার ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫-এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে দেওয়া একাধিক আবেদনের প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন রায় ঘোষণা করেছে। আবেদনকারীরা আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং আইন কার্যকর করার উপর স্থগিতাদেশ চেয়েছিলেন।

১২৮ পাতার এই রায়ে প্রধান বিচারপতি বি. আর. গাভাই ও বিচারপতি এ. জি. মাসিহর বেঞ্চ বলেন—প্রাথমিকভাবে তাঁরা মনে করেন না যে সবগুলো ধারাই স্বেচ্ছাচারী বা অসাংবিধানিক। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারার উপর স্থগিতাদেশ বা স্পষ্টীকরণ দেওয়া হয়েছে।

 

এই আইনের পটভূমি: ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫ মুসলিমদের দ্বারা ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে দানকৃত সম্পত্তি (যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, অনাথাশ্রম) নিয়ন্ত্রণ করে, যা বিক্রি করা যায় না এবং সম্প্রদায়ের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। এই সম্পত্তিগুলির মূল্য কয়েকশো বিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালের এপ্রিলে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-নেতৃত্বাধীন সরকার এই আইন সংশোধন করে, যাতে ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ধারণ ও পরিচালনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। সরকার দাবি করে যে এটি স্বচ্ছতা বাড়াবে, কিন্তু মুসলিম গ্রুপ এবং বিরোধী দলগুলি বলছে যে এটি মুসলিম অধিকারে হস্তক্ষেপ। পিটিশনকারীদের মধ্যে রয়েছে এআইএমআইএম সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি, দিল্লি এএপি বিধায়ক আমানাতুল্লাহ খান, জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দের সভাপতি আরশাদ মাদানি প্রমুখ।

কোর্টের অন্তর্বর্তী রায়ে প্রাইমা ফেসি পর্যবেক্ষণের হাইলাইটস নিম্নরূপ, যাতে অতিরিক্ত তথ্য (যেমন ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ, অতিরিক্ত উদ্ধৃতি এবং প্রতিক্রিয়া) যোগ করা হয়েছে: নিম্নে আদালতের পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্তগুলির সারাংশ তুলে ধরা হল—

১. ওয়াক্‌ফ সৃষ্টিকারী অবশ্যই মুসলিম এবং কমপক্ষে ৫ বছর ইসলাম অনুশীলনকারী হওয়ার ধারা – সীমিত স্থগিতাদেশ

আইনের ধারা 3(r) অনুযায়ী, যিনি ওয়াক্‌ফ তৈরি করবেন তাঁকে অবশ্যই অন্তত পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালনকারী হতে হবে। আদালত বলেছে—এটি আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক নয়, কারণ যে কেউ শুধু ঋণদাতাদের ঠকাতে বা সম্পত্তি আড়াল করতে নামমাত্র ইসলাম গ্রহণ করতে পারেন, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তবে আদালত স্পষ্ট করে দেয়—এই ধারা কার্যকর করার আগে যথাযথ নিয়ম বা প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে। যেহেতু বর্তমানে এই পাঁচ বছরের প্রমাণ যাচাইয়ের কোনো বিধি নেই, তাই আপাতত এই ধারার প্রয়োগ স্থগিত থাকবে।

সিজেআই গভাই বলেছেন, "এই ধারা অযৌক্তিক নয়, কিন্তু ব্যবস্থা ছাড়া এটি স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে।"

২. ‘ওয়াক্‌ফ বাই ইউজার’ – কোনো স্থগিতাদেশ নেই

আগের আইনে ‘ওয়াক্‌ফ বাই ইউজার’ ধারণা ছিল, যেখানে দীর্ঘ ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ হিসেবে গণ্য হত। সংশোধনী আইনে এটি বাতিল করা হয়েছে।

আদালত বলেছে, এটি অসাংবিধানিক নয়, কারণ সরকারের যুক্তি অনুযায়ী এই বিধান শুধুমাত্র ভবিষ্যতের জন্য প্রযোজ্য। আগে থেকে থাকা ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি এতে প্রভাবিত হবে না।

আদালত আরও মন্তব্য করে—অনেক সরকারি জমি অবৈধভাবে ওয়াক্‌ফ দেখিয়ে দখল করা হয়েছিল, তাই সংসদ এই ব্যবস্থা বাতিল করতে পারে। তবে বিদ্যমান ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি নিয়ে কোনো পরিবর্তন কেবলমাত্র ওয়াক্‌ফ ট্রাইব্যুনাল বা হাইকোর্টের নির্দেশে হবে।

"যদি ২০২৫ সালে বিধানসভা 'ওয়াকফ বাই ইউজার' ধারণার কারণে বিপুল সরকারী সম্পত্তি দখল হয়েছে বলে মনে করে এবং এটি বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এই সংশোধনী প্রাইমা ফেসি অযৌক্তিক বলা যাবে না।" 

নতুন আইনে অ-নিবন্ধিত ওয়াকফগুলির জন্য ৬ মাসের নিবন্ধন সময় দেওয়া হয়েছে, এবং দেরি আবেদনের বিধান রয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নিবন্ধন বাধ্যতামূলক ছিল না, কিন্তু মুতাওয়াল্লিরা এটি করেনি।

৩. সরকারী কর্মকর্তার রিপোর্ট না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান ওয়াকফ সম্পত্তির স্বয়ংক্রিয় ডি-রিকগনিশন – স্থগিত

ধারা 3C অনুযায়ী, কোনো সরকারি অফিসার তদন্ত না করা পর্যন্ত বিদ্যমান ওয়াক্‌ফকে অস্থায়ীভাবে অবৈধ ধরা হবে।

আদালত বলেছে—এটি ক্ষমতার বিভাজনের নীতি ভঙ্গ করে, কারণ কোনো রাজস্ব অফিসার সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণ করতে পারেন না। এটি বিচারিক বা আধা-বিচারিক কর্তৃপক্ষের কাজ। তাই এই ধারা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।

ধারা ৩সি(২)-এর প্রোভিসো, ৩সি(৩) এবং ৩সি(৪) স্থগিত। কালেক্টরকে নাগরিকদের অধিকার নির্ধারণের অনুমতি দেওয়া ক্ষমতা বিভাজনের বিরুদ্ধে।

৪. প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পত্তি (ASI মনুমেন্ট) থেকে ওয়াক্‌ফ মর্যাদা অপসারণ – স্থগিত নয়

ধারা 3D অনুযায়ী, যেসব জায়গা প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণ আইন, ১৯০৪ বা ১৯৫৮ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক আইন অনুযায়ী সুরক্ষিত, সেগুলো ওয়াক্‌ফ হিসেবে গণ্য হবে না।

আদালত বলেছে—এতে ধর্মীয় অধিকারের লঙ্ঘন হয় না। আইন অনুযায়ী নাগরিকরা সুরক্ষিত এলাকায়ও তাদের প্রচলিত ধর্মীয় আচার চালিয়ে যেতে পারেন। তাই এ ধারা বহাল থাকবে।

৫. আদিবাসী জমি ওয়াক্‌ফ ঘোষণা নিষিদ্ধ – স্থগিত নয়

ধারা 3E অনুযায়ী, কোনো আদিবাসী জমিকে ওয়াক্‌ফ ঘোষণা করা যাবে না। আদালত বলেছে—এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী (অনুসূচি জাতি ও উপজাতি) রক্ষার জন্য আনা হয়েছে। তাই এটি অযৌক্তিক নয়।

৬. ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য সংখ্যা – সীমা স্পষ্টকরণ

সংশোধনী আইনে সর্বোচ্চ ১২ জন কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে এবং ৭ জন রাজ্য বোর্ডে অমুসলিম সদস্য থাকার সুযোগ রয়েছে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে—বাস্তবে ৪ জনের বেশি অমুসলিম কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে এবং ৩ জনের বেশি অমুসলিম রাজ্য বোর্ডে রাখা হবে না। আদালত এটিকে নথিভুক্ত করে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, যাতে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে।

৭. রাজ্য বোর্ডের সিইও অবশ্যই মুসলিম হতে হবে না – স্থগিত নয়

আইনের ধারা ২৩ অনুযায়ী, রাজ্য বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO) রাজ্য সরকারের একজন কর্মকর্তা হবেন, এবং তিনি মুসলিম কিনা তা বাধ্যতামূলক নয়।

আদালত বলেছে—যেহেতু বোর্ড মুসলিম-অধ্যুষিত থাকবে, তাই এটি অযৌক্তিক নয়। তবে আদালত সুপারিশ করেছে—সম্ভব হলে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাউকেই CEO হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত।

৮. সব ওয়াক্‌ফ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক – স্থগিত নয়

ধারা ৩৬ অনুযায়ী সব ওয়াক্‌ফ নিবন্ধন করা আবশ্যক। আদালত বলেছে—এটি নতুন কোনো বিধান নয়, পূর্ববর্তী আইনেও নিবন্ধনের নিয়ম ছিল। তাই এটি বহাল থাকবে।

৯. অমুসলিমদের ওয়াক্‌ফ সৃষ্টির অধিকার বাতিল – স্থগিত নয়

আগে ধারা ১০৪ অনুযায়ী অমুসলিমরা তাদের সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করতে পারতেন। এই ধারা বাতিল করা হয়েছে।

আদালত বলেছে—ওয়াক্‌ফ ইসলাম ধর্মের বিশেষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, তাই অমুসলিমদের এই অধিকার থাকা উচিত নয়। তবে অমুসলিমরা চাইলে তাদের সম্পত্তি কোনো ট্রাস্টে দান করতে পারেন, আর সেই ট্রাস্ট পরে ওয়াক্‌ফ তৈরি করতে পারবে।

১০. ওয়াক্‌ফ বিরোধে সীমাবদ্ধতা আইন (Limitation Act) প্রযোজ্য – স্থগিত নয়

ধারা ১০৭ অনুযায়ী, ওয়াক্‌ফ সম্পর্কিত মামলায়ও ১৯৬৩ সালের সীমাবদ্ধতা আইন প্রযোজ্য হবে। আদালত বলেছে—যেহেতু অন্য সব অস্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় এই আইন প্রযোজ্য, তাই ওয়াক্‌ফ নিয়ে আলাদা নিয়ম রাখার যৌক্তিকতা নেই।

সুপ্রিম কোর্টের এই অন্তর্বর্তী রায়ে দেখা যাচ্ছে—কিছু ধারা (যেমন ৫ বছর ইসলাম পালনের শর্ত, সরকারি অফিসারের তদন্ত ছাড়া ওয়াক্‌ফ বাতিল) আপাতত স্থগিত করা হয়েছে, তবে বেশিরভাগ সংশোধনী বহাল রাখা হয়েছে।

এই রায় ভবিষ্যতে চূড়ান্ত শুনানির ভিত্তি তৈরি করবে। এখন দেখা বাকি, সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে চূড়ান্ত রায়ে আদালত কী সিদ্ধান্ত দেয়।

Post a Comment

Post a Comment