অমৃত ভারত এক্সপ্রেস: বিহারের জন্য নির্বাচনী উপহার নাকি পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে পরিহাস?

অমৃত ভারত এক্সপ্রেস: বিহারের জন্য নির্বাচনী উপহার নাকি পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে পরিহাস?
অমৃত ভারত এক্সপ্রেস: বিহারের জন্য নির্বাচনী উপহার নাকি পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে পরিহাস?

দৃঢ়ভাবে দাবি না করলেও, অনুমান করে বলাই যায় যে গত ১১ বছরে বিহার যতগুলি নতুন ট্রেন পায়নি, তার চেয়ে অনেক বেশি ট্রেন পেয়েছে এই নির্বাচনী মাসগুলিতে। বর্তমানে ভারতে নয়টি অমৃত ভারত এক্সপ্রেস চলছে, যার মধ্যে আটটি বিহার থেকে ছাড়ছে বা বিহারের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনা বিহারে এক ভিন্ন বিতর্ক উস্কে দিয়েছে: পরিযায়ণ (Migration) থামানোর যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার কী হলো? এই ট্রেনগুলি কি পরিযায়ণকে আরও দ্রুত করার জন্য চালানো হচ্ছে? মূল সমস্যা তো ছিল পরিযায়ণ কমানো।

বিহারের রাজনীতিতে রেলগাড়ির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বরাবরই ছিল। রামবিলাস পাসোয়ান, নীতীশ কুমার এবং লালু যাদব—সকলেই নতুন ট্রেন চালিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে বিহার এবং নতুন ট্রেনের চাহিদার রাজনৈতিক সম্পর্কটি যেন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে নতুন ট্রেনের দাবি প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না। আর এখন, যখন সেই দাবি প্রায় স্তব্ধ, তখন হঠাৎ করেই একের পর এক অমৃত ভারত এক্সপ্রেস চালু করা হচ্ছে।

'বিশ্বমানের' তকমার আড়ালে ধীরগতির বাস্তবতা:
বিহারের মানুষকে কাজের জন্য বাইরে যেতে হয় এবং উৎসব-পার্বণে ফিরেও আসতে হয়। তাই তাদের কাছে একটি নতুন ট্রেন সবসময়ই সুখবর। কিন্তু অমৃত ভারত এক্সপ্রেসকে যেভাবে 'বিশ্বমানের' বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নতুন ডিজাইন এবং রঙের ট্রেন দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে রেল নিয়ে আবার আগ্রহ তৈরি হতে পারে, কিন্তু রাজনীতি যখন এই রোমাঞ্চকে মোড়কে ভরে বিক্রি করার চেষ্টা করে, তখন সেই মোড়ক খুলে দেখা উচিত ভেতরে কী আছে।

দেখা যাচ্ছে, অমৃত ভারত এক্সপ্রেস নিয়ে বেশ তাড়াহুড়ো রয়েছে। কোথাও এটি দৈনিক চলছে, কোথাও সপ্তাহে একদিন বা দু'দিন। সম্ভবত ট্র্যাক নতুন ট্রেনের জন্য প্রস্তুত নয়, কিন্তু নির্বাচনের কারণে জায়গা তৈরি করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এর গতি এবং সময় নিয়ে। দিল্লি থেকে পাটনাগামী সম্পূর্ণ ক্রান্তি এক্সপ্রেস ১৩ ঘণ্টা সময় নেয়, অথচ নতুন 'বিশ্বমানের' অমৃত ভারত এক্সপ্রেস নিচ্ছে ১৫ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। মুম্বাই-সাহারসা হামসফর এক্সপ্রেস যেখানে সাড়ে ৩৩ ঘণ্টা সময় নেয়, সেখানে অমৃত ভারত এক্সপ্রেস নিচ্ছে ৩৮ ঘণ্টা। যদি অমৃত ভারত 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস' হয়, তাহলে হামসফর বা অন্যান্য এক্সপ্রেস ট্রেনগুলি কী?

স্টপেজের অজুহাত এখানে খাটে না। দিল্লি-পাটনা অমৃত ভারত এক্সপ্রেসের মাত্র ১০টি স্টপেজ, যা মগধ এক্সপ্রেসের ২২টি স্টপেজের অর্ধেকেরও কম, তবুও এটি বেশি সময় নিচ্ছে। বেশি স্টপেজ রাখার কারণ হতে পারে আরও বেশি বিধানসভা কেন্দ্রকে ছুঁয়ে যাওয়া। কিন্তু এতে পরিযায়ী শ্রমিকের সময়ের মূল্য কোথায়? তাদের ছুটি কম থাকে, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে। বাড়ি ফেরার পথে সময় বাঁচানোটা তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। গয়া থেকে দিল্লিগামী অমৃত ভারত এক্সপ্রেস ১৯.৫ ঘণ্টা সময় নিচ্ছে এবং ভাড়া ৫৬০ টাকা। অথচ একই রুটে চলা নেতাজি এক্সপ্রেস ৪ ঘণ্টা কম সময় নেয় এবং স্লিপার ক্লাসের ভাড়াও ৪০ টাকা কম। তাহলে এই ধীরগতির ট্রেন আজ কার প্রয়োজন মেটাচ্ছে?

এসি বিহীন 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস': উন্নয়নের উল্টো যাত্রা?
পিআইবি-র প্রেস রিলিজে এবং এমনকি রেলমন্ত্রীর সংসদে দেওয়া বয়ানেও অমৃত ভারত এক্সপ্রেসকে "স্বল্প খরচে বিশ্বমানের সুবিধা" প্রদানকারী ট্রেন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসি ছাড়া একটি ট্রেন কীভাবে 'বিশ্বমানের' হতে পারে? যে মিডিয়া একে 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস' লিখছে, তারা হয়তো 'ওয়ার্ল্ড' বা 'ক্লাস' কোনোটাই দেখেনি।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৬ সালে সাহারসা থেকেই লালু যাদব পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য 'গরিব রথ' চালু করেছিলেন, যা ছিল একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (AC) ট্রেন। ১৯ বছর পর, সেই একই সাহারসা থেকে যখন একটি নন-এসি, জেনারেল ও স্লিপার কোচের ট্রেন চালু করে 'অমৃত ভারত' নাম দেওয়া হয়, তখন কি এটা উন্নয়ন, নাকি পশ্চাদপসরণ? এমন কোনো প্রযুক্তি কি বিশ্বে নেই যা গরিবদের স্বল্প ভাড়ায় এসি ট্রেন পরিষেবা দিতে পারে? উন্নয়ন তো তখন হতো, যখন সমস্ত ট্রেনকে এসি করা হতো। সিসিটিভি ক্যামেরা, বায়ো-টয়লেট, জার্ক-ফ্রি কোচ—এগুলো আজকের দিনে সাধারণ সুবিধা, 'বিশ্বমানের' বৈশিষ্ট্য নয়।

নির্বাচনী সমীকরণ এবং পরিযায়ণের রাজনীতি:
তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, এই ট্রেনগুলির বেশিরভাগই চালু হয়েছে ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে, যা বিহার নির্বাচনের ঠিক আগে। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩-এ প্রথম অমৃত ভারত ট্রেন চালু হয়েছিল। এরপর এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে আরও ছয়টি চালু হয়। এই ট্রেনগুলির রুট সেই শহরগুলিতেই যাচ্ছে, যেখানে বিহার থেকে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজের খোঁজে যান—দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ।

এই ট্রেনগুলি চালু করার মাধ্যমে কি সরকার পরিযায়ণকে সুবিধা করে দিচ্ছে না? যাদের পরিযায়ণ আটকানোর কথা ছিল, তারাই এখন পরিযায়ণকে আরও সহজ করার জন্য ট্রেন চালাচ্ছে এবং একে 'বিকাশ' বলছে। এর পাশাপাশি, বিহারের মুজফফরপুর, সহরসা, সুপৌলের মতো জায়গায় নতুন বিমানবন্দর তৈরির খবরও ছড়ানো হচ্ছে, যেমনটা উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগেও দেখা গিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, বিহার সরকারের আর্থিক সমীক্ষা (২০২৩) অনুযায়ী যেখানে রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ পরিবারের মাসিক আয় ৬০০০ টাকারও কম, তারা কি বিমানে চড়বে? একদিকে নন-এসি ট্রেন আর অন্যদিকে বিমানবন্দরের স্বপ্ন—এই দ্বিচারিতা আসলে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার কৌশল।

বাস্তবতা হলো, বিহারে ট্রেনের সংখ্যা অপর্যাপ্ত হওয়ার কারণে হাজার হাজার শ্রমিক আনন্দ বিহার (দিল্লি) থেকে ১৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা খরচ করে অনিরাপদ এসি স্লিপার বাসে যাতায়াত করতে বাধ্য হন। বছরের পর বছর ধরে তাদের এই দুর্দশার কথা কেউ ভাবেনি। এখন নির্বাচনের মুখে, দীপাবলি এবং ছট পূজার আগে বিহারগামী টিকিটে ২০% ছাড় ঘোষণা করা হচ্ছে। এই ছাড় পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজার সময় কেন দেওয়া হয় না? কারণ সেখানে এখন নির্বাচন নেই।

আসলে, অমৃত ভারত এক্সপ্রেস হলো মোদী সরকারের অর্থনৈতিক নীতির বাস্তব প্রতিচ্ছবি। এটি এমন একটি ট্রেন যা স্বীকার করে নেয় যে বিহারে কাজ নেই, এবং সেখানকার মানুষের বাইরে যাওয়া-আসাই একমাত্র বাস্তবতা। এই ট্রেন চালিয়ে সরকার দেখাতে চাইছে যে তারা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ভাবছে, কিন্তু আসলে এটি একটি নির্বাচনী চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। যে মন্ত্রীরা এসি ট্রেনে এবং বিমানে ঘোরেন, তারা যখন শ্রমিকদের একটি নন-এসি, ধীরগতির ট্রেন দিয়ে সেটিকে 'বিশ্বমানের' বলেন, তখন তা সেই শ্রমিকদের সঙ্গে পরিহাস ছাড়া আর কী হতে পারে? বিহারের মানুষ ট্রেন চায়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা 'ক্লাস' এবং 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস'-এর পার্থক্য বোঝে না।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url