 |
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অশনি সংকেত: মধ্যবিত্তের স্বপ্ন এবং অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সংকটে |
একসময় ভারতীয় মধ্যবিত্তের স্বপ্ন পূরণের চাবিকাঠি এবং দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত তথ্যপ্রযুক্তি (IT) সেক্টর আজ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। যে ক্ষেত্রটি প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তা এখন মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য লড়াই করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এবং ভারতীয় সংস্থাগুলির দূরদৃষ্টির অভাবের মতো একাধিক কারণ এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর ফলস্বরূপ, কর্মী ছাঁটাই এক সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা শুধুমাত্র লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার উপরই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, রিয়েল এস্টেট এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উপরেও এক অন্ধকার ছায়া ফেলেছে।
এক স্বপ্নের সূচনা: Y2K সংকট এবং ভারতের উত্থান
১৯৯৮ সালের আগে পর্যন্ত ভারতের আইটি সেক্টর তেমন বড় ছিল না। কিন্তু 'Y2K' সংকট গোটা বিশ্বের কাছে একটি বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হলে ভারতের ভাগ্য খুলে যায়। পুরনো কম্পিউটার সিস্টেমে সাল উল্লেখ করার জন্য কেবল দুটি সংখ্যা ব্যবহার করা হতো (যেমন '৯৮' মানে ১৯৯৮)। ২০০০ সাল আসার সাথে সাথে সিস্টেমের কাছে '০০' সালের অর্থ বোঝা এক বিরাট প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মতো দেশগুলি বিপুল খরচের সম্মুখীন হচ্ছিল, তখন ভারতীয় আইটি সংস্থাগুলি অত্যন্ত কম খরচে এবং দক্ষতার সাথে এই কাজটি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (TCS), ইনফোসিস এবং উইপ্রোর মতো সংস্থাগুলি বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। এর পর থেকেই ভারত বিশ্বের আউটসোর্সিং হাবে পরিণত হয়। আইটি সেক্টরের হাত ধরে ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে। মোটা মাইনের চাকরি, বিদেশে যাওয়ার সুযোগ এবং উন্নত জীবনযাত্রার স্বপ্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিকে তাদের সন্তানদের ইঞ্জিনিয়ার বানাতে উৎসাহিত করে। এর ফলে দেশ জুড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং কোচিং সেন্টারের রমরমা শুরু হয়।
সংকটের নেপথ্যে যে কারণগুলি
আজ ভারতের আইটি সেক্টরের এই দুর্দশার জন্য কোনো একটি কারণ দায়ী নয়, বরং একাধিক বিষয় এর জন্য দায়ী।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) প্রভাব: ভারতীয় আইটি সংস্থাগুলি মূলত বেসিক কোডিং, টেস্টিং এবং সাপোর্টের মতো কাজের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখন চ্যাটজিপিটি-র মতো জেনারেটিভ এআই টুলগুলি এই ধরনের কাজগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং দ্রুত করতে সক্ষম। এর ফলে, যে কাজগুলির জন্য এতদিন বিপুল সংখ্যক কর্মীর প্রয়োজন হতো, তা এখন এআই-এর মাধ্যমে সহজেই করা যাচ্ছে, যার ফলে সংস্থাগুলি কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এবং পরিবর্তিত রাজনীতি: ভারতীয় আইটি সেক্টরের প্রায় ৬০% রাজস্ব আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এবং ৩০% আসে ইউরোপ থেকে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিদেশি সংস্থাগুলি তাদের আইটি বাজেট কমিয়ে দিচ্ছে এবং নতুন প্রকল্প বাতিল করছে। এছাড়াও, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতাদের "অ্যান্টি-আউটসোর্সিং" নীতি ভারতের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে।
আইটি সংস্থাগুলির আত্মতুষ্টি: ভারতীয় আইটি সংস্থাগুলির ব্যবসায়িক মডেল ছিল কম খরচে বিপুল সংখ্যক কর্মী নিয়োগ করে পরিষেবা প্রদান করা। তারা কখনও গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) তেমন বিনিয়োগ করেনি বা নিজেদের কর্মীদের নতুন এবং জটিল প্রযুক্তি শেখানোর দিকে নজর দেয়নি। নতুন প্রোডাক্ট বা প্রযুক্তি তৈরির পরিবর্তে তারা কেবল পরিষেবা প্রদানেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা: দেশের অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এখনও পুরনো সিলেবাসে পড়ানো হয়, যা বর্তমান সময়ের চাহিদার সাথে একেবারেই বেমানান। এর ফলে, প্রতি বছর যে লক্ষ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হচ্ছে, তাদের মধ্যে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব দেখা যাচ্ছে।
সংকটের সুদূরপ্রসারী প্রভাব
আইটি সেক্টরের এই সংকট শুধুমাত্র কর্মীদের উপরই নয়, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে।
অর্থনীতি ও শেয়ার বাজার: আইটি সেক্টর ভারতের জিডিপিতে প্রায় ৭.৪% অবদান রাখে এবং দেশের মোট রপ্তানির একটি বড় অংশ এখান থেকেই আসে। এই সেক্টরের বৃদ্ধি কমে যাওয়ায় দেশের জিডিপি এবং বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। টিসিএস, ইনফোসিসের মতো বড় সংস্থাগুলির শেয়ারের দামেও পতন দেখা গেছে।
রিয়েল এস্টেট এবং অন্যান্য ব্যবসা: আইটি কর্মীরাই ছিলেন ফ্ল্যাট, গাড়ি এবং অন্যান্য বিলাসদ্রব্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তাদের চাকরি চলে যাওয়ায় বা বেতন না বাড়ায় রিয়েল এস্টেট সেক্টরে চাহিদা কমছে এবং ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা: চাকরি না পাওয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রতি ছাত্রদের আগ্রহ কমছে। গত কয়েক বছরে লক্ষ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং আসন খালি পড়ে রয়েছে এবং অনেক কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে।
ভবিষ্যতের পথ: ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল
এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কিছু সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, গড় মানের দক্ষতার দিন শেষ; এখন প্রয়োজন উচ্চ এবং জটিল দক্ষতার।
রিস্কিলিং এবং আপস্কিলিং: পুরনো দক্ষতার আর চাহিদা নেই। কর্মীদের অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং (ML), ডেটা সায়েন্স এবং সাইবারসিকিউরিটির মতো নতুন প্রযুক্তি শিখতে হবে। আগামী কয়েক বছরে ভারতে এআই এবং সাইবারসিকিউরিটি ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
উদ্ভাবনে বিনিয়োগ: ভারতীয় আইটি সংস্থাগুলিকে এখন পরিষেবার পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি এবং প্রোডাক্ট তৈরির দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। তাদের গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার: কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পাঠ্যক্রমকে আধুনিক শিল্পের প্রয়োজন অনুসারে বদলাতে হবে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা শেষ করার পরেই কাজের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, ভারতীয় আইটি সেক্টর এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তবে সঠিক পদক্ষেপ এবং নতুন প্রযুক্তির সাথে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে এই সংকটকে একটি সুযোগে পরিণত করা সম্ভব। গড়পড়তা কর্মীর যুগ শেষ, এখন সেরারাই টিকে থাকবে এবং তারাই এই সেক্টরকে এক নতুন দিশা দেখাবে।