মাদুরাইয়ের জনসভায় বিজয়ের গর্জন: বিজেপিকে ‘নীতিগত শত্রু’ ও ডিএমকে-কে ‘রাজনৈতিক শত্রু’ ঘোষণা

অভিনেতা থেকে নেতা হওয়া থালাপতি বিজয় মাদুরাইয়ের সমাবেশে ২০২৬ সালের তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনের রণহুঁশিয়ার দিলেন। বিজেপিকে ‘নীতিগত শত্রু’ ও ডিএমকে-কে ‘রাজনৈতিক শত্রু’ আখ্যা দিয়ে তিনি মোদী ও স্ট্যালিনকে তীব্র আক্রমণ করেন। সিংহের উদাহরণ টেনে সাহস, সততা ও পরিবর্তনের বার্তা দেন এবং ঘোষণা করেন—২৩৪ আসনেই প্রার্থী বিজয়।
Actor-turned-politician and Tamilaga Vettri Kazhagam president Vijay. File | Photo Credit: PTI

মাদুরাই: অভিনেতা থেকে নেতা হওয়া থালাপতি বিজয় তার রাজনৈতিক দল 'Tamilaga Vettri Kazhagam' (TVK)-এর বিশাল সমাবেশে দাঁড়িয়ে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কার্যত সুর বেঁধে দিলেন। মাদুরাইয়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি একদিকে যেমন বিজেপি-কে দলের ‘নীতিগত শত্রু’ এবং ক্ষমতাসীন ডিএমকে-কে ‘রাজনৈতিক শত্রু’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, তেমনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম. কে. স্ট্যালিনকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানিয়েছেন। তার ভাষণের কিছু অংশ বাংলা অনুবাদ সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের আঙ্গিকে তুলে ধরা হলো।

"সিংহের মতো বাঁচব, সিংহের মতোই লড়ব।"

সিংহের একটা স্বভাব আছে। সে কখনও ছোট বিষয়ে মাথা ঘামায় না। যখন একটা সিংহ গর্জন করে, তখন ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত চারদিক কেঁপে ওঠে। সেই সিংহ শুধু শিকার করার জন্যই বের হয়। তামাশা দেখতে নয়।

শিকার করার সময়ও সে জীবন্ত পশুকে শিকার করে। বিশেষ করে নিজের চেয়ে বড় আকারের পশুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং জয়ী হয়। যত খিদে থাক না কেন, মরা বা পচা মাংস সে ছুঁয়েও দেখে না। সেই সিংহ সহজে কিছুতে হাত দেয় না, কিন্তু যদি একবার ধরে, তাহলে আর ছাড়ে না।

জঙ্গলের মধ্যে সে নিজের সীমানা তৈরি করে রাখে, এবং 'নিজের এলাকা' বলে চিহ্নিত করে। এভাবেই সে জঙ্গলকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে। সিংহের যেমন দলবদ্ধভাবে থাকতে জানে, তেমনই একা থাকতেও ভয় পায় না। যদি একা আসার প্রয়োজন হয়, সে কোনো ভয় বা সংকোচ ছাড়াই একা এসে সবাইকে জল খাইয়ে দেয়। সে কখনও নিজের স্বকীয়তা হারায় না।

আমরা যখন সিংহদের নিয়ে কথা বলছি, তখন সিংহী এবং শাবকদের কথা না বলে কি থাকতে পারি? তারাই তো সিংহদের প্রাণশক্তি। আমার হৃদয়ে থাকা সকল বন্ধু, সহকর্মী এবং যে সকল মায়েরা, বোনেরা, ভাইয়েরা এবং বন্ধুরা সরাসরি আসতে পারেননি, কিন্তু বাড়ি থেকে এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, তাদের সবাইকে আমার আন্তরিক প্রণাম।

বীরত্বের এই মাদুরাই মাটিকে আমি প্রণাম জানাই। মাদুরাইয়ের কথা মনে পড়লেই প্রথমে মনে আসে আলঙ্গানাল্লুর জাল্লিকাট্টুর কথা, যেখানে ষাঁড়েরা সাহসিকতার সঙ্গে খেলে। মনে পড়ে আমাদের ভাইগাই নদী, আজাগরের নদীতে নামার উৎসব এবং মাদুরাই মীনাক্ষী আম্মানের কথা। এই মাটি আবেগপ্রবণ মানুষের মাটি।

এই মাটিতে পা রাখার পর থেকেই আমার একজনের কথা মনে পড়ছিল, যাকে আপনারাও চেনেন। সিনেমা হোক বা রাজনীতি, আমাদের সবার প্রিয় 'পুরাটচি থালাইভার' এমজিআর (M. G. Ramachandran)। তার সঙ্গে মেশার সুযোগ আমার হয়নি, কিন্তু তার মতোই গুণসম্পন্ন আমার বড় ভাই, 'ক্যাপ্টেন' বিজয়কান্তের সঙ্গে আমার অনেক মেশার সুযোগ হয়েছে। তিনিও তো এই মাদুরাইয়েরই সন্তান। তাকে কি ভোলা যায়?

আমাদের 'Tamilaga Vettri Kazhagam' (TVK)' যে রাজনীতি হাতে নিয়েছে, সেটাও এমনই এক আবেগপূর্ণ এবং সৎ রাজনীতি।

ইতিহাস ফিরবে, ২০২৬-এ পরিবর্তন আসবে, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৭ সালে তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে একটা বড় ক্ষমতার পরিবর্তন এসেছিল। তেমনই আগামী বছর, ২০২৬ সালেও সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা সেই বার্তাই দিতে এসেছি।

আমাদের বিরুদ্ধে কত আওয়াজ উঠেছে! কিন্তু আপনারা তো আমাদের চেনেন। আমরা অন্যের কথায় কান না দিয়ে শুধু মানুষের কণ্ঠ শুনি। আমাদের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত চিৎকারকে আমরা একটা ছোট্ট হাসির সঙ্গে পার করে এসেছি। এই কণ্ঠ শুধু একজন তামিলের নয়, এটা তামিলনাড়ুর প্রত্যেক ঘরের কণ্ঠস্বর। 

আমরা রাজনীতিতে আসার আগে অনেকে বলেছিল, "ও আসবে না।" যখন দলের নাম ঘোষণা করলাম, তখন বলল, "এতে কী হবে, মানুষের মন জিততে পারবে না।" যখন সম্মেলনের কথা বললাম, তখন বলল, "একা একা কী করে করবে?" বৃষ্টি এসে সব ভেস্তে দেবে। কিন্তু কী হয়েছে, তা আপনারা সবাই দেখেছেন। এখন নতুন কথা বলছে - "ক্ষমতা দখল করা অত সহজ নয়।"

আমি সেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বলতে চাই, এই বিজয় শুধু লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে নেই। আমাদের এই জমায়েত শুধু ভোটে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আগামী নির্বাচনে জনবিরোধী শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের জবাব হবে। কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে এবং ঘরে আমরা ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছি। আমাদের সম্পর্ক সরাসরি মানুষের সঙ্গে।

আমাদের দলের পথপ্রদর্শক হলেন পাঁচজন মহান ব্যক্তিত্ব - পেরিয়ার, কামরাজ, আম্বেদকর, ভেলু নাচিয়ার এবং আনজালাই আম্মাল। আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট এবং এখানে কোনো আপোসের জায়গা নেই।

আমাদের একমাত্র নীতিগত শত্রু হলো বিজেপি।
এবং আমাদের একমাত্র রাজনৈতিক শত্রু হলো ডিএমকে।

আমরা কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড ডিল করে জোট তৈরি করার দল নই। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কারণ আমাদের সঙ্গে নারীশক্তি এবং যুবশক্তি আছে। তামিলনাড়ুর সাধারণ মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে। যখন কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা আমাদের সঙ্গে, তখন ফ্যাসিবাদী বিজেপির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জোট করার আমাদের কী প্রয়োজন? আমরা কি কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত দল?

আমাদের জোট হবে আত্মমর্যাদার জোট। একদিকে আরএসএস-এর কাছে মাথা নত করে, আর অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার নাটক করে মানুষকে বোকা বানানোর জোট আমাদের হবে না।

২০২৬ সালের লড়াইটা হবে মূলত দুজনের মধ্যে - একদিকে TVK, অন্যদিকে DMK। যারা পুরনো গণিত আর জোটের সমীকরণ দিয়ে জেতার স্বপ্ন দেখছে, তাদের স্বপ্ন সফল হবে না।

প্রধানমন্ত্রী মোদীকে প্রশ্ন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজি, আপনি তৃতীয়বার দেশের শাসনভার হাতে নিয়েছেন। আমরা জানতে চাই, আপনি কি সমস্ত মানুষের ভালোর জন্য ক্ষমতায় এসেছেন, নাকি আমাদের মুসলিম বন্ধুদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার জন্য?

মানুষের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন আমি আপনাকে করতে চাই, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার। আমাদের প্রায় ৮০০-র বেশি মৎস্যজীবীকে শ্রীলঙ্কার নৌসেনা আক্রমণ করেছে। আমরা বড় কিছু চাইছি না, শুধু কাচ্চাতিভু দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার থেকে ফিরিয়ে এনে আমাদের মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। আপনার একগুঁয়েমির কারণে যে 'নিট' (NEET) পরীক্ষা চলছে, তার জন্য এখানে যা ঘটছে তা বলতেও কষ্ট হয়। দয়া করে সেই পরীক্ষা বাতিল করুন। আপনি কি এটা করবেন, মিস্টার নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীজি?

আপনারা আমাদের প্রয়োজনগুলো পূরণ করেন না, কিন্তু ক্ষমতার জোরে আমাদেরকে বোকা বানিয়ে চলেছেন। একদিকে বিজেপির প্রত্যক্ষ জোট, আর অন্যদিকে আরএসএস-এর সঙ্গে পরোক্ষ বোঝাপড়া। কিন্তু জেনে রাখুন, পদ্মপাতায় যেমন জল টেকে না, তামিলনাড়ুর মানুষও আপনাদের সঙ্গে থাকবে না। এখানে একটাও সাংসদ না জেতার কারণে আপনারা তামিলনাড়ুর সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছেন। আপনারা আমাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আপনাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না।

স্ট্যালিন আঙ্কেল, আপনার সরকার কী করছে? এখন যারা ক্ষমতায় আছে, সেই ডিএমকে কী করছে? তারা বিজেপির সঙ্গে ভিতরে ভিতরে সম্পর্ক রেখে বাইরে বিরোধিতার নাটক করছে। যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন "গো ব্যাক মোদী" স্লোগান দিত, আর এখন ক্ষমতায় এসে "ওয়েলকাম মোদী" বলে ছাতা ধরছে। একটা রাইড হলেই দিল্লি ছুটে যায় গোপন বৈঠক করতে, আর তারপর বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যায়।

স্ট্যালিন আঙ্কেল, এটা কিন্তু খুব ভুল, আঙ্কেল। আপনার বিবেক থাকলে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনার শাসনে কি সততা আছে? ন্যায় আছে? দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে? আইন-শৃঙ্খলা কি ঠিক আছে? নারীরা কি সুরক্ষিত? সাধারণ মানুষ কি সুরক্ষিত? বলুন, মাই ডিয়ার আঙ্কেল।

আপনি মহিলাদের ১০০০ টাকা দিয়ে ভাবছেন সব ধামাচাপা দিয়ে দেবেন? কিন্তু মেয়েরা পড়াশোনার জায়গায়, কাজের জায়গায়, বাইরে কোথাও সুরক্ষিত নয় বলে কাঁদছে। সেই কান্নার আওয়াজ কি আপনার কানে পৌঁছায়, আঙ্কেল?

আপনি কৃষকদের ধোঁকা দিয়েছেন, সরকারি কর্মীদের ধোঁকা দিয়েছেন, মৎস্যজীবীদের ধোঁকা দিয়েছেন, আর মাদক সংস্কৃতি বন্ধ না করে যুব সমাজকে ধোঁকা দিচ্ছেন। আপনারা যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা কি পূরণ করেছেন?

খুব শীঘ্রই আমি মানুষের কাছে যাব, তাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলব। তারপর এই সাধারণ গর্জন ঝড়ে পরিণত হবে, যা আপনাদের এক মুহূর্তও ঘুমাতে দেবে না।

২৩৪টি আসনেই প্রার্থী আমি, ২০২৬ সালের নির্বাচনে এই কপট ডিএমকে সরকারকে আমরা বাড়ি পাঠাব।

আর এখন আমি আমাদের দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করছি।‌ মাদুরাই (পূর্ব) - প্রার্থী বিজয়। মাদুরাই (পশ্চিম) - প্রার্থী বিজয়। মাদুরাই (মধ্য) - প্রার্থী বিজয়।

শুধু মাদুরাই নয়, তামিলনাড়ুর ২৩৪টি আসনেই প্রার্থী এই বিজয়, অর্থাৎ আপনাদের ঘরের ছেলে। আপনারা যখন আপনাদের এলাকার প্রার্থীকে ভোট দেবেন, জানবেন সেই ভোট আমাকেই দিচ্ছেন।

আমি কোনো বাজার পড়ে যাওয়ার পর অবসর জীবনে রাজনীতিতে আসিনি। আমি প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। আর এর কারণ হলো কৃতজ্ঞতার ঋণ। গত ৩০ বছর ধরে আপনারা আমার পাশে আছেন। আপনাদের এই ভালোবাসা শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই, কোনোদিন হবেও না। আমার এখন একটাই কাজ - মানুষের সেবা করা।

শাসকের সততা সবচেয়ে বড় পরিচয়। তাই পরিশেষে একটি ছোট গল্প বলি—এক রাজা সেনাপতি নির্বাচনের জন্য দশজনকে একটি করে সেদ্ধ বীজ দিয়ে বললেন, তিন মাস পর অঙ্কুরিত চারাগাছ নিয়ে আসতে। তিন মাস পর সবাই বড় বড় গাছ নিয়ে এলো, কিন্তু একজন খালি পাত্র নিয়ে হাজির হলো। সে বিনয়ের সঙ্গে বলল,
“মহারাজ, আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু এই বীজ থেকে কোনো চারা গজায়নি।”

রাজা তাকেই সেনাপতি হিসেবে বেছে নিলেন। কারণ, তিনি সবাইকে সেদ্ধ বীজ দিয়েছিলেন, যা থেকে চারা গজানো অসম্ভব। বাকি নয়জন মিথ্যা দিয়ে রাজাকে ধোঁকা দিয়েছিল, কিন্তু একজন সৎ থেকে সত্য বলেছিল।

আপনারাই সেই রাজা, আর আপনাদেরও একজন সৎ সেনাপতি বেছে নিতে হবে। মনে রাখবেন—সব রাজনীতিবিদ যেমন জ্ঞানী নন, তেমনই সব সিনেমার মানুষও মূর্খ নন। আত্মবিশ্বাসী থাকুন, ভালো কিছুই হবে। জয় নিশ্চিত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url