১৯৯৮ সালের ঘটনা। ভারত তার পরমাণু বিস্ফোরণের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল পাকিস্তানে। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ রিয়াদে ফোন করেন। ক্রাউন প্রিন্স আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের সামনে অনুরোধ করেন: পাকিস্তান যদি প্রত্যুত্তরে পরমাণু বিস্ফোরণ করে, তাহলে কি সৌদি আরব পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে? কারণ, তারপর আসা নিষেধাজ্ঞাগুলো দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে ফেলবে। এটি নিশ্চিত ছিল।
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক কতটা গভীর, তা আন্দাজ করুন এই ঘটনা থেকে: পাকিস্তানের পরমাণু পরীক্ষার পর সৌদি আরব প্রতিদিন ৫০০ ব্যারেল তেল বিনামূল্যে পাঠায়। এই তেলের কারণেই পাকিস্তান নিষেধাজ্ঞা থেকে বেঁচে যায়। এই সপ্তাহে সেই নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই এবং পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ রিয়াদে পৌঁছান। নয়াদিল্লির সঙ্গে সংঘর্ষের কয়েক মাস পরই তাদের পুরনো বন্ধুর সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি এখন দু'দেশের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক সামরিক জোট গড়ে তুলেছে। এর ফলে এক দেশে আক্রমণ দু'দেশের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য হবে। বাকি বিশ্ব এটিকে ইসরায়েলি আক্রমণ থেকে সৌদিকে রক্ষা করার কৌশল হিসেবে দেখছে। পাকিস্তানের পরমাণু ছাতার একটি সম্প্রসারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ভাবুন, যদি কাতারের মাঝখানে ইসরায়েল আক্রমণ করতে পারে এবং আমেরিকার এত ভালো বন্ধু হয়েও আমেরিকা কাতারে এই আক্রমণ হতে দেয়, তাহলে বাকি উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের নিরাপত্তার জন্য কিছু তো করবে।
ভারতের জন্য নতুন মাথাব্যথা
কিন্তু ভারতের জন্য এই কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি একটি নতুন মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নয়াদিল্লির জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: কল্পনা করুন, যদি আবার সময় আসে যখন ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি দাঁড়ায়—ক্রিকেট পিচে নয়, আসল মাঠে। তাহলে কি সৌদি আরব পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে? এবং যদি সৌদি আরব পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়, তাহলে সেই ২৫ লক্ষ ভারতীয়ের কী হবে যারা সৌদি আরবে কাজ করছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আপনাকে জানিয়ে রাখি, এই চুক্তি এ সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের জন্য একমাত্র খারাপ খবর নয়। এখন খবর আসছে যে, আমেরিকা ভারতের জন্য ইরানের চাহবাহার বন্দরে যে নিষেধাজ্ঞা ছাড়পত্র দিয়েছিল, সেটি এখন বাতিল করেছে। এতদিন আমেরিকা ভারতকে এই বন্দরে নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু এবার ট্রাম্প সরকার মোদীকে বন্ধু বলে ডেকে তার পিঠে আবার ছুরি মারল। যদি এই নিষেধাজ্ঞা না সরে, তাহলে ভারতের আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য খুব খারাপভাবে প্রভাবিত হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে ভারতকে একের পর এক ধাক্কা লাগার পর এখন সকলেই অন্তত এটুকু বুঝেছে যে, কূটনীতি একটি নেতার জন্য জন্মদিনের শুভেচ্ছা, পুরস্কার বা সম্মান বা গ্র্যান্ড স্বাগতম, এসবের শেষ হয় না। বরং ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের বাইরে কূটনীতির উদ্দেশ্য হলো দেশের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ভারতের কূটনীতি এবং বিদেশনীতি এখন শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত পিআর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে, যার খেসারত এখন সমগ্র দেশকে ভোগ করতে হচ্ছে। ভাবুন, যেদিন হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাঙ্কেলরা বুর্জ খলিফায় 'হ্যাপি বার্থডে মোদী জি' ভিডিও ফরোয়ার্ড করছিলেন, সেই দিনই প্রতিবেশী দেশে পাকিস্তানি নেতৃত্ব তাদের ভারতবিরোধী জোটকে আরও শক্তিশালী করছিল। আজকাল সেই লেজার চোখও আশেপাশে দেখা যায় না। প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা হয়নি। তারপর মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রত্যাখ্যান শুরু হয়েছে। চীনের এসইও-তেও তাকে দেখা যায়নি এবং এখন পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে আমাদের জয়শঙ্কর জি সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
প্রথমে পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তিকে ঘনিষ্ঠভাবে বোঝার চেষ্টা করব। এই চুক্তির পিছনে ভূ-রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কী? তা দেখার চেষ্টা করব। এবং কেনই বা সৌদি আরব আজ তার নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানের কাছে যেতে বাধ্য হয়েছে। ভারতের ওপর এই চুক্তির প্রভাব কী পড়বে? ভারত-সৌদি সম্পর্ক এই চুক্তি থেকে কীভাবে প্রভাবিত হবে এবং শেষে দেখব যে, শুল্কের পর আমেরিকা কেন আবার ভারতের পিছনে হাত ধুয়ে পড়েছে। কেন চাহবাহার বন্দরে নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় বিদেশনীতির জন্য একটি বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে। এবং হ্যাঁ, শেষে কি আমেরিকার পর এখন মধ্যপ্রাচ্যও ভারতের হাত থেকে সরে যাচ্ছে।
পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি: সৌদি পেট্রো-ডলারের ভূমিকা
এটি সকলেই জানেন যে, পাকিস্তান তার পরমাণু বোমা তৈরির জন্য শ্রম, অর্থ, দণ্ড, ভেদ সবকিছু ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানের কাছে ততটা অর্থ ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানের পরমাণু বোমার পিতা আবদুল কাদির খান ১৯৮০-১৯৯০-এর দশকে গোপনে সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তি পাকিস্তানে চোরাইপথে নিয়ে আসেন। পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবসা করেন। লিবিয়া, ইরানের মতো দেশের সঙ্গে অবৈধ ব্যবসা করেন। এসব কথা খান নিজেই স্বীকার করেছেন। আমি বলছি না। কিন্তু যে কথার আলোচনা কম হয় তা হলো, কীভাবে সৌদি পেট্রো-ডলার এত বছর ধরে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচিকে জীবিত রেখেছে। এই কথার উল্লেখ পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফিরোজ খান তার বই 'ইটিং গ্রাস: দ্য মেকিং অব দ্য পাকিস্তানি বম্ব'-এ লিখেছেন।
আমেরিকা থেকে সাহায্য এবং আইএমএফ থেকে ঋণের কথা তো পাকিস্তান প্রসঙ্গে অনেক বলা হয়, কিন্তু এটি কম যে, ১৯৬০ সাল থেকে পাকিস্তান সৌদি আরব থেকে অগণিত সাহায্য পেয়ে আসছে। পাকিস্তানও তার তৃতীয় বৃহত্তম শহরের নাম বদলে ফয়সালাবাদ রাখে সৌদি আরবের কিং ফয়সালের সম্মানে। এবং তখন থেকে একটি প্রত্যাশা ছিল যে, দু'টি সুন্নি-প্রধান দেশ শেষপর্যন্ত একটি সামরিক বন্ধন স্থাপন করবে, যা এই সপ্তাহে অবশেষে ঘটেছে। যখন পাকিস্তানের সর্বশক্তি সামরিক প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিফ মুনির এবং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এই চুক্তি চূড়ান্ত করেন। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে স্বাক্ষর করেন। এখনও এই চুক্তির সব বিস্তারিত তথ্য সামনে আসেনি। কিন্তু এই চুক্তির একটি ধারা সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এবং সেই ধারা হলো: 'যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসন দু'দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বলে গণ্য হবে।' এই ধারা অনেকটা ন্যাটোর আর্টিকল 5এর মতো, যেখানে একটির ওপর আক্রমণ সকলের ওপর আক্রমণ বলে মনে করা হয়। এজন্য এই নতুন পাকিস্তান-সৌদি চুক্তিকে ইসলামিক ন্যাটোর শুরু হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট বলেছেন যে, অন্যান্য আরব দেশগুলোও এই চুক্তির অংশ হতে পারে। 'দরজা বন্ধ নয়।' তাই ভবিষ্যতে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা কাতারের মতো দেশগুলোও এই চুক্তির অংশ হয়ে যেতে পারে। যাকে সত্যিকার অর্থে বলা যায় একটি ইসলামিক বা আরব সংস্করণের ন্যাটোর জন্ম হতে পারে। আরেকটি বিষয় যেমন আমরা সকলে জানি, পাকিস্তান একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ। এখন প্রশ্ন উঠছে যে, এই চুক্তির পর সৌদি আরবকে রক্ষা করার জন্য কি পাকিস্তান তার পরমাণু প্রতিরোধক ব্যবহার করবে? কি এই চুক্তি থেকে পাকিস্তানের পরমাণু ছাতা সৌদি আরবকেও আচ্ছাদিত করবে, এখনও এ নিয়ে কোনো অফিসিয়াল নিশ্চিতকরণ আসেনি। দু'দেশের শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা বলেছেন যে, এই চুক্তির অধীনে একে অপরকে রক্ষা করার জন্য সকল উপলব্ধ ক্ষমতা ব্যবহার করা হবে। তাই যতক্ষণ না কোনো অফিসিয়াল অস্বীকার আসে, এটি নিরাপদে ধরে নেওয়া যায় যে, এই চুক্তি পরমাণু সুরক্ষাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
সামরিক সহযোগিতা
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। সৌদি আরব সেই প্রথম দেশগুলোর মধ্যে একটি যা ১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর তাৎক্ষণিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫১ সালে দু'দেশ মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা দশকের পর দশক ধরে কৌশলগত, রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে তোলে। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী কয়েকবার সৌদিতে মোতায়েন হয়েছে সৌদি সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। অফিসিয়াল রেকর্ড অনুসারে, ১৯৬৭ সাল থেকে পাকিস্তান ৮,০০০-এর বেশি সৌদি সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ১৯৭৯ সালের গ্র্যান্ড মসজিদ দখলের পর এই সামরিক বন্ধন আরও গভীর হয়। যখন পাকিস্তানের বিশেষ বাহিনী সৌদি সেনাদের সঙ্গে মিলে মসজিদ আল-হারামের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে।
কয়েক বছর পর ১৯৮২ সালে দু'দেশ দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, সহায়তা এবং সৌদি ভূমিতে পাকিস্তানি মোতায়েনকে প্রাতিষ্ঠানিক করে। এরপর কিছু ক্ষেত্রে ২০,০০০ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনা সৌদি আরবে অবস্থান করেছে। সৌদি আরব আজ পাকিস্তান-নির্মিত অস্ত্রের একটি বড় আমদানিকারকও হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি পাকিস্তান ও সৌদির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শুধু অগ্রসর করে না। এটি একটি ভিন্ন জিনিস। এই চুক্তি এমন সময়ে আসছে যখন মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আসলে ধসে পড়ছে।
ব্যাখ্যা করছি কীভাবে? আজ ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে ইচ্ছে যখন ইচ্ছে যাকে ইচ্ছে আক্রমণ করছে। ইরান, সিরিয়া, লেবানন, কাতার—সর্বত্র ইসরায়েলি জেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ করতে পারছে। এখন এই দেশগুলোর নিজস্ব সার্বভৌমত্ব, ভূখণ্ডীয় অখণ্ডতা সবকিছু উপেক্ষা করে ইসরায়েল একটি গুন্ডার মতো আচরণ করছে। সেই আমেরিকা যা দশকের পর দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা প্রদানকারী এবং শান্তি নির্মাতা হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ সেই আমেরিকা ইসরায়েলকে এই অবৈধ আক্রমণগুলো করতে দিচ্ছে বা উপেক্ষা করছে বা চুপচাপ সমর্থন করছে। আমেরিকার ইসরায়েলের প্রতি এই অন্ধ সমর্থনের পিছনে অনেক জটিল কারণ রয়েছে। কিন্তু কারণ যাই হোক। এবং আমেরিকার নীরবতার কারণ যাই হোক। সত্য তো এটাই যে, মধ্যপ্রাচ্যে আজ যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় ইসরায়েল আক্রমণ করতে পারে।
হামাস একটি অজুহাত, বাহানা এবং এই অঞ্চলে ৪০০০০ থেকে ৫০০০০ সেনা মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা তার আরব মিত্রদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে পারছে না বা চাইছে না। এখন এমন পরিস্থিতিতে দেশগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেরাই করতে হবে। সৌদি আরবের রাজপরিবার বছরের পর বছর ধরে দেশের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতা রক্ষায় মনোযোগী ছিল। বহিরাগত নিরাপত্তার জন্য আমেরিকা তো আছেই। এখন এমন পরিস্থিতিতে সৌদি এবং অন্যান্য আরব রাজতন্ত্রগুলো অগণিত অর্থ থাকা সত্ত্বেও কখনো সামরিক শক্তিতে মনোযোগ দেয়নি। বা বলা যায়, আমেরিকা তাদের মনোযোগ দিতে দেয়নি। আমেরিকা বলেছে, আমরা আছি, তোমাদের কিছু করার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে পাকিস্তান অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে আলাদা করে একমনা ভাবে ভারতকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তার সামরিক বাহিনীতে মনোযোগ দিয়ে আসছে।
যদিও দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, লোকেরা কষ্ট সহ্য করে, খাবার না পায়, কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্র থাকতে হবে, পরমাণু অস্ত্র থাকতে হবে, পরমাণু বোমা থাকতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে আজ পাকিস্তানকে আইএমএফ থেকে ঋণের পর ঋণ দেওয়া হচ্ছে তাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু তবু সে ইসলামিক বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। সৌদির মতো দেশগুলো বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানকে অর্থ এবং ঋণ দিয়ে ডিফল্ট থেকে বাঁচিয়ে আসছে। এখন পাকিস্তানের পালা সেগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার।
সৌদি নেতারা সবসময় মেনে নিয়েছেন যে, ইরানের মতো তাদের সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র এবং পরমাণু শক্তিতে বিনিয়োগ করার দরকার নেই। কারণ, যদি দরকার পড়ে তাহলে এসব পাকিস্তান থেকে সহজেই কিনতে বা ঋণে নিতে পারে। ১৯৯৯ সালে সৌদি আরবের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাকিস্তানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন এবং পাকিস্তানকে অনুরোধ করেন যে, প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান তাদের দেশের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হোক। তার কৃতিত্বে, ইসলামাবাদ এমন অনুরোধগুলো বারবার এড়িয়ে গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌদি আরবের আসল পরিকল্পনা অন্য। পাকিস্তানকে যে অর্থনৈতিক সমর্থন দেওয়া হচ্ছে তা গ্যারান্টি দেয় যে, যেদিন দরকার পড়বে সেদিন তারা পাকিস্তানের পরমাণু বোমা ভাড়ায় নিতে পারবে। আজ যদি ইরানের কাছে পরমাণু প্রযুক্তি থাকে। যদি ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণহীন বোমাবর্ষণ করছে তাহলে সৌদি আরবকেও দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নিতে হবে। সৌদি আরব তার দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন বুঝুন যে, আমাদেরও কেন প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার।
ভারতের উদ্বেগ: যুদ্ধ হলে কী হবে?
আজ ভারত এবং দেশবাসীদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ এটাই যে, কাল যদি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের কারণে আমরা আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই, যুদ্ধ হয় তাহলে কি সৌদি আরব পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়াবে? তার সঙ্গে দাঁড়াবে। ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ করবে। কারণ, আকর্ষণীয় বিষয় এটি যে, সৌদি আরব ভারতের সঙ্গে সবসময় ভালো রাজনৈতিক, কৌশলগত, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে দশকের পর দশক ধরে। ভারত ও সৌদি আরব একে অপরকে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার বলে গণ্য করে। আর্থিক বছর ২৩২৪-এ আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৪৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যাতে ভারতীয় রপ্তানি ১২ বিলিয়ন এবং আমদানি ৩২ বিলিয়ন। এছাড়া আজ সৌদি আরবে প্রায় ২৫ লক্ষ ভারতীয় বাস করেন যারা সেখানকার অর্থনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন।
জানুয়ারি ২০০৬-এ কিং আবদুল্লাহর ভারত সফর দু'দেশের জন্য ঐতিহাসিক বলে মনে করা হয়। তারপর ২০১০-এ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রিয়াদ সফর করেন। কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী হয়। গত ১১ বছরে মোদী সরকারও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছে।
২০১৬-এ প্রধানমন্ত্রী মোদী রিয়াদ যান তাহলে কিং সালমান তাকে তার রাজ্যের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান দিয়ে সম্মানিত করেন। এই বছর ২ এপ্রিল পহেলগাম আক্রমণের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদী সৌদি আরবে ছিলেন এবং তার সৌদি হোস্ট তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘটনাকে নিন্দা করেন। পরে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অপারেশন সিন্দুরের সময় ভারতে একটি অঘোষিত সফর করেন। তাই সামগ্রিকভাবে দেখলে এটি সত্য যে, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে খুব ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব রয়েছে। কিন্তু এটিও সত্য যে, গত কয়েক বছরে ভারত সরকার সৌদি আরবের সঙ্গে একটি স্বাধীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশী দূতাবাসকর্মী, বিশেষজ্ঞদের মতে, যদিও চুক্তিতে সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েছে, কিন্তু যখন সত্যিই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘাতের কথা আসবে, তাহলে হয়তো সৌদি আরব তার প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকবে না।
ভারত সরকারের কথা যে, পাকিস্তান ও সৌদির মধ্যে এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল তা তাদের আগেই জানা ছিল এবং আজও ভারত সরকার এর প্রভাব অধ্যয়ন করছে। কিন্তু যতক্ষণ আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রক তার বিশ্লেষণ শেষ করে, ততক্ষণ আমরা মনে করতে পারি তাদের এখন পর্যন্ত রিপোর্ট কার্ডটা জানিয়ে দিই। আজ অপারেশন সিন্দুরের ৪ মাস পরও কোনো বড় দেশ সামনে আসেনি বলার জন্য যে, আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং ভারতের সঙ্গে দাঁড়িয়েছি। সন্ত্রাসকে সকলে নিন্দা করেছে কিন্তু পাকিস্তানের কড়া নিন্দা কেউ করেনি। ওদিকে পাকিস্তানকে তুরস্ক, আজারবাইজানের মতো দেশগুলো আগেই তাদের অকপট সমর্থন দিয়েছে এবং এখন আমেরিকা এবং শেষে সৌদি আরবের মতো দেশ তার আরও কাছে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে যে পাকিস্তানকে বিশ্বে নাম করে এবং লজ্জা দিয়ে সন্ত্রাসের বিষয়ে বিচ্ছিন্ন করার ছিল, আজ সেই উল্টো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে আরও একীভূত হয়েছে।
অন্যদিকে ভারত যা বছরের পর বছর ধরে সকলের অংশীদার ছিল। একটি ভালো বিশ্বাসযোগ্যতা রাখত। তার ওপর আজ আমেরিকা শুল্কের পর শুল্ক লাগাচ্ছে। আমাদের বন্দরগুলোতে নিষেধাজ্ঞা লাগানো হচ্ছে। আমাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু চীনের সঙ্গে হাত মেলাতে হচ্ছে। এবং আশেপাশের কথা না বলাই ভালো। প্রথমে বাংলাদেশ থেকে দূরত্ব। এখন মোদী জি এবং গোদি মিডিয়ার কল্যাণে নেপালের লোকেরাও থু-থু করে ভারতবিরোধী ভাবাবেগ দেখাচ্ছে। এখন এটি সরাসরি লেজার। এটি ব্যর্থতা না হলে কী তা আমি জানি না। কারণ, সম্পূর্ণ কূটনীতিতে যখন আপনার উদ্দেশ্য সিগমা রিলস তৈরি করা, মোদী জির ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং এবং পিআর করা, তাহলে দেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য জায়গা কোথায় থাকে?
আজ বিশ্বও বুঝেছে যে, ভারতকে কোনো বাস্তব ছাড় দেওয়ার দরকার নেই। শুধু মোদী জিকে পুরস্কার দিন। জয়শঙ্কর সাহেবকে রিলস তৈরি করতে দিন। গ্র্যান্ড স্বাগতম করুন, ছবি তুলুন। হাউডি মোদী টাইপের একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করুন। প্রবাসী ভারতীয়দের একটু সম্বোধন করুন। ভারত খুশি হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বাস্তব অংশীদারিত্ব, বাস্তব প্রভাব দেখানোর দরকার নেই। এই ললিপপ কূটনীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ যদি আমি আপনাদের দিই তাহলে এই সপ্তাহেই সেটি সামনে এসেছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার গোদি মিডিয়ার ফুফু হয়ে যান। সকলে এখন শুল্ক হ্রাসের কথা বলতে শুরু করেন। বলেন, এবার তো বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গেল। অন্যদিকে সেই সময় পিছন থেকে আমেরিকা ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী বন্দরে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে যে, ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ইরানের চাহবাহার বন্দরের জন্য নিষেধাজ্ঞা ছাড়পত্র প্রত্যাহার করা হবে। এর ফলে ভারতকে দেওয়া ৭ বছরের পুরনো ছাড়পত্র বাতিল হয়ে যাবে। এখন ভারতের জন্য আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় পৌঁছানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাবে।
২০১৮-এর ছাড়পত্র ভারতের জন্য চাহবাহার বন্দর পরিচালনার একটি আইনি ঢাল ছিল। এই আইনি আচ্ছাদনের ভরসাতেই নয়াদিল্লি গত বছর একটি দীর্ঘমেয়াদী লিজ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে যার ফলে ভারত সরকারের ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড বা আইপিজিএলকে ১০ বছরের জন্য এই বন্দর পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য তো আগেই বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে চাহবাহার বন্দর আমাদের জন্য আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পৌঁছানোর একটি মূল পথ ছিল। এর ওপর চাহবাহার আমাদের আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। পাকিস্তান ও চীনের যৌথ উদ্যোগ গোয়াদার বন্দরের একটি আঞ্চলিক প্রতিযোগীও এটি ছিল। তাই আমেরিকার একটি ধাক্কা ভারতের বিদেশনীতিকে একাধিক স্তরে কীভাবে ধ্বংস করতে পারে তা এই সপ্তাহে আমরা দেখেছি। যদিও এটি সরাসরি আমেরিকার ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল। এটি আমি মানি কারণ, বাণিজ্য চুক্তি আবার শুরু হতে চলেছে। আলোচনা আবার শুরু হতে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত থেকে সর্বোচ্চ ছাড় কীভাবে নেওয়া যায়?
চলো আমরা এখানেও নিষেধাজ্ঞা লাগানোর কথা বলি। ছাড়পত্র প্রত্যাহারের কথা বলি। কিন্তু মূল কথায় ফিরে আসি। আমেরিকা কেন আমাদের এমন হুমকি দিতে পারছে? এটি বোঝার দরকার, অভ্যন্তরীণ আলোচনা করার দরকার। আমেরিকা এত সহজে এটি করতে পারছে কারণ তারা জানা যে, ভারতের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই। একদিকে আমাদের চীন আছে। ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি হয়ে গেছে। সেই দেশ যা আমাদের দেশের কিছু অংশ খেয়ে বসে আছে। অন্যদিকে আমাদের আমেরিকা আছে। হয় আমরা আমাদের বাজার তাদের জন্য খুলে দিই অথবা তারা আরও নিষেধাজ্ঞা লাগাবে।
চীনের মতো আমাদের কাছে সেই শক্তি, সেই ক্ষমতা, সেই উৎপাদন নেই যে আমরাও আমেরিকার ওপর উল্টো শুল্ক ঘোষণা করি। তাই ট্রাম্প মোদীকে ভালো কথা শোনাচ্ছে। তার বন্ধু বলছে। পিছন থেকে ছুরি মারছে এবং ততক্ষণ মারবে যতক্ষণ না ভারত তার কথা মানে। কিন্তু এর মাঝে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য আমাদের হাত থেকে কীভাবে সরে যাচ্ছে এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাসের ট্যাপ সত্ত্বেও সে কীভাবে আজ একটি ভূ-রাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থানে বসে আছে তা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। চীন হোক, ইরান হোক, সৌদি আরব হোক, আমেরিকা হোক—সকলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সকলের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছে। এবং এখানে জয়শঙ্কর জির লেজার চোখ পাকিস্তানের এই কূটনীতি থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন কি আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারব?