ইডি’র জালে জীবনকৃষ্ণ সাহা: পালানোর চেষ্টা, নর্দমায় মোবাইল, পুরনো অভ্যাসেই বারবার ধরা
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা আবারও ইডির জালে ধরা পড়লেন |
নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আবারও শোরগোল। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ফের বড়সড় পদক্ষেপ নিল কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বৃহস্পতিবার ভোরে ইডির আধিকারিকরা হানা দেন তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা এবং তাঁর পিসি মায়া সাহার বাড়িতে। যদিও মায়া সাহাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, কিন্তু ভাইপো জীবনকৃষ্ণ সাহাকে আটক করে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় ইডির দফতরে।
ঘটনার নাটকীয় দিক ছিল পালানোর চেষ্টা। ইডি সূত্রে জানা যায়, আধিকারিকরা দরজায় দীর্ঘক্ষণ নক করার পরও ভেতর থেকে কেউ দরজা খোলেননি। সন্দেহ হওয়ায় তাঁরা বাড়ির পেছনের দিকে যান এবং তখনই দেখতে পান, বিধায়ক পেছনের খিরকির দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। হঠাৎ ছুটে বেরিয়ে তিনি ঝোপের মধ্যে পড়ে যান এবং কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়েন। ঠিক সেই মুহূর্তেই ইডির আধিকারিকরা তাঁকে পাকড়াও করেন।
পুনরাবৃত্তির অভিযোগ
রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে—একই ভুল কি তিনি বারবার করছেন? কারণ, এর আগে সিবিআই যখন সাহার বাড়িতে হানা দিয়েছিল, তখনও তিনি পাঁচিল টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়ও তিনি ধরা পড়েছিলেন। এবারও একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। সমালোচকদের বক্তব্য, একজন জননেতা হয়েও যদি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শেখা না যায়, তবে তা কেবল রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিগত বুদ্ধিমত্তারও ব্যর্থতা।
ফোন ফেলার কাণ্ড আবারও
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ইডির হানার সময় জীবনকৃষ্ণ সাহা তাঁর মোবাইল ফোন নর্দমায় ছুড়ে ফেলেন। উল্লেখযোগ্য, সিবিআই হানার সময়ও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি নিজের ফোন পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন। তখন সিবিআই জল ঘেঁটে ফোন উদ্ধার করেছিল। এবার ইডি আধিকারিকরা ফোনটির রিং শোনার সূত্র ধরে নর্দমা থেকে সেটি উদ্ধার করেন।
বিতর্ক এখানেই—জেলে থাকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরও কি তিনি কিছু শিখলেন না? জনমানসে প্রশ্ন জাগছে, কেন বারবার ফোন লুকোনোর চেষ্টা করছেন? তাঁর কি আশঙ্কা ছিল যে ফোনের ভেতর থাকা তথ্য তাঁকে বেকায়দায় ফেলতে পারে?
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও সালাউদ্দিনের প্রশ্ন
অন্যদিকে সামনে এসেছে আরও এক অভিযোগ। ২০২২ সালে সালাউদ্দিন শেখ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জীবনকৃষ্ণ সাহা প্রায় ১.১০ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। প্রতিশ্রুতি ছিল, তাঁকে একটি বালির ঘাট পাইয়ে দেবেন। কিন্তু গ্রেপ্তারের কারণে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরও তিনি টাকা ফেরত দেননি কিংবা প্রতিশ্রুত কাজও করেননি।
সালাউদ্দিনের দাবি, তিনি আইনের দ্বারস্থ হয়েছেন। এখন জীবনকৃষ্ণ সাহার ফের গ্রেপ্তারের পর প্রশ্ন উঠছে—“সালাউদ্দিন কি কখনও তাঁর টাকা ফেরত পাবেন?”
শিক্ষক হলেও অনুপস্থিত
রাজনীতির পাশাপাশি জীবনকৃষ্ণ সাহার আরেক পরিচয় রয়েছে। তিনি পেশায় একজন জীববিজ্ঞানের শিক্ষক। কিন্তু অভিযোগ, তিনি খুব কমই স্কুলে যেতেন। সহকর্মীরা জানান, তাঁকে সচরাচর স্কুলে দেখা যেত না। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর একদিন তিনি নাটকীয়ভাবে স্কুলে উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের “মাছের শ্বাসপ্রক্রিয়া” পড়িয়েছিলেন।
শিক্ষা মহলের একাংশের বক্তব্য—যদি তিনি নিয়মিত শিক্ষকতায় মন দিতেন, তবে অন্তত ইডির হানার দিনে স্কুলে থাকলে সহজেই পালিয়ে যেতে পারতেন। কারণ তখন তাঁর বাড়িতে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যেত না। অনেকে তাই বিদ্রুপ করে বলছেন—“এডুকেশন ইজ ইম্পর্টেন্ট।”
ধর্মকর্ম ও গ্রেপ্তার
ঘটনার আরও একটি দিক হলো ধর্মকর্ম। ইডির গ্রেপ্তারের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে জীবনকৃষ্ণ সাহা একটি বিশেষ পূজা আয়োজন করেছিলেন। মাথায় গামছা, হাতে প্রণামভঙ্গি, চোখে জল—এমন ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে তিনি লিখেছিলেন: “মা, সবার মঙ্গল করো।”
কিন্তু এরপরেই গ্রেপ্তার হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে—এ কি ঈশ্বরেরই বিচার? সমালোচকরা কটাক্ষ করে বলছেন, “মানুষের মঙ্গল নয়, মা এবার ভণ্ডামি বরদাস্ত করেননি।”
চারটি জ্বলন্ত প্রশ্ন
পুরো ঘটনার পর জনমানসে চারটি জ্বলন্ত প্রশ্ন উঠে এসেছে—
-
একই ভুল বারবার কেন?
সিবিআইয়ের সময়ও পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, এবারও করলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু শেখা গেল না কেন? -
ফোন লুকোনোর নাটক কেন?
বারবার মোবাইল ফেলে দেওয়ার ঘটনা কি প্রমাণ করে না যে তিনি ভেতরে এমন তথ্য রেখেছিলেন যা তাঁকে বিপদে ফেলতে পারে? -
সালাউদ্দিনের টাকা ফেরত হবে কি?
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার পরও তিনি দায় স্বীকার করেননি। এবার গ্রেপ্তারের পর সালাউদ্দিনের ভবিষ্যৎ কী? -
ধর্মকর্ম কি রক্ষা করতে পারল?
পূজা করার পরই গ্রেপ্তার—এ কি ভগবানেরই ইঙ্গিত যে দুর্নীতি আর ভণ্ডামি সহ্য করা হবে না?
রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর রাজ্য রাজনীতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিরোধীরা কটাক্ষ করেছেন—“শিক্ষক হয়ে ছাত্রদের না পড়িয়ে কেবল দুর্নীতি আর পালানোর কৌশলই শিখলেন।” আবার শাসকদলের একাংশ বলছে—“আইন আইনের পথে চলবে, আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে।”
জীবনকৃষ্ণ সাহার এই গ্রেপ্তার কেবল দুর্নীতি মামলার জন্য নয়, তাঁর বারবার একই ধরনের ভুল সিদ্ধান্তের জন্যও জনমানসে প্রবল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একদিকে তাঁর পালানোর চেষ্টা, অন্যদিকে ফোন নর্দমায় ফেলার নাটক—সব মিলিয়ে প্রশ্ন জাগছে, তিনি কি কখনও বাস্তব শিক্ষা নিতে সক্ষম হবেন?
আজকের এই ঘটনাই প্রমাণ করছে, দুর্নীতি যখন কনস্ট্যান্ট, তখন শিক্ষা, সততা ও নৈতিকতা হয়ে উঠছে অ্যাবসেন্ট ভ্যারিয়েবল।