 |
Credit: Mint |
ক্ষমতায় এলে শিল্প গড়ে দেখিয়ে দেব—এই ছিল ২০১১ সালের একটি জনপ্রিয় প্রতিশ্রুতি। তারপর ২০১৪ সালে এলো আরেকটি বড় দাবি: প্রতি বছর দু’কোটি চাকরি দেওয়া হবে। ২০২১ সালে আবার শোনা গেল ‘ডবল ডবল চাকরি হবে’—অর্থাৎ চাকরির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিগুলো আলাদা হলেও বাস্তব চিত্রটা একই রকম। বছরের পর বছর কেটে গেছে, ভোটের পর ভোট এসেছে, সঙ্গে এসেছে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি। কিন্তু চাকরির অবস্থা? তা এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন। ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে ভারতের বেকারত্বের হার ৫.২% থেকে ৫.৬% এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, যা ট্রেডিং ইকোনমিক্স এবং রয়টার্সের রিপোর্ট অনুসারে। বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে এই হার আরও উদ্বেগজনক—শহুরে এলাকায় ১৯% এবং গ্রামীণ এলাকায় ১৩.৮%। একদিকে দেশকে বলা হচ্ছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম জিডিপি-সম্পন্ন অর্থনীতি, যা ২০২৫ সালে ৪.১৯ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে (আইএমএফ এবং ফোর্বসের তথ্য অনুসারে), অপরদিকে বেকারত্বের হার এমন যে যুবকরা গুরুকুল থেকে বেরিয়ে একটা সাধারণ চাকরি পর্যন্ত পাচ্ছে না।
২০৩০ সালের মধ্যে ভারতকে ‘বিশ্বগুরু’ বলে ঘোষণা করা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে যুবকদের জীবন নির্বাহের জন্য চাকরির অভাব একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় সরকার বছরের পর বছর কোনো নতুন চাকরির শূন্যপদ ঘোষণা করছে না। যেটুকু ঘোষণা হচ্ছে, তার পরীক্ষা ঠিকমতো নেওয়া যাচ্ছে না। লিক হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নপত্র, বাতিল হচ্ছে পরীক্ষা। রাজ্য স্তরে তো চিত্র আরও খারাপ। একের পর এক সরকারি চাকরির প্যানেল বাতিল হচ্ছে। চুরি হচ্ছে শিক্ষা, চাকরি এবং স্বপ্ন। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালে বিহারে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ যুবক প্রতিবাদ করেছে। গোয়াতে ‘ক্যাশ ফর জবস’ কেলেঙ্কারিতে অনেকগুলি গ্রেফতার হয়েছে, যেখানে সরকারি চাকরির জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে। এই ধরনের দুর্নীতি শুধু চাকরি হারায় না, যুবকদের আস্থা ভেঙে দেয়।
প্যান্ডেমিকের পর ভারতের জিডিপি বেড়েছে, কিন্তু সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্বের হারও। ২০২৫ সালে পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস) অনুসারে, জুন মাসে বেকারত্ব ৫.৬% ছিল, যা এপ্রিলের ৫.১% থেকে বেড়েছে। একদিকে নতুন স্টার্টআপের বন্যা, অপরদিকে প্যান্ডেমিকের পর হাজার হাজার চাকরি হারিয়েছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ: টিসিএস ২০২৪-২০২৫ সালে ১২,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। সুইগি ২০২৪ সালে ৪০০ কর্মী, বাইজুস ২০২৪-২০২৫ সালে ৫০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। ফ্লিপকার্ট, ওলা, সিম্পল সহ অনেক স্টার্টআপে হাজার হাজার চাকরি গেছে। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ভারতীয় স্টার্টআপে ৩,৬০০ কর্মী ছাঁটাই হয়েছে (ইনক৪২ রিপোর্ট)।
প্রতি বছর ভারতে যে পরিমাণ ইঞ্জিনিয়ার পাস আউট হয়, তা স্কটল্যান্ডের জনসংখ্যার থেকে বেশি—প্রায় ১৫ লক্ষ। কিন্তু ২০২৫ সালে ৮০% বিটেক ইঞ্জিনিয়ার বেকার বা অযোগ্য (ফরচুন ইন্ডিয়া এবং লিঙ্কডইন রিপোর্ট)। ৯৩% এমবিএ পাসআউটের কোনো ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স নেই, এমনকি বেসিক স্কিলও নেই। ২০২৫ সালে এমবিএ গ্র্যাজুয়েটদের এমপ্লয়েবিলিটি ৭৮% এ উঠেছে (স্ট্যাটিস্টা), কিন্তু ৫০% এখনও চাকরিহীন। কেন এমন হচ্ছে? ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও সরকার চাকরি দিতে পারছে না। শুধু সরকারের দোষ? না, এর পিছনে শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সিস্টেমেরও দায় আছে।
আমাদের দেশে যখনই একটা বাচ্চা জন্মায়, তখনই ঠিক করে নেওয়া হয় যে সে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। ছোট থেকেই সেইভাবে পড়াশোনা শুরু। স্কুল থেকেই কেউ নিটের জন্য পড়ে, কেউ জেইই। যারা এর বাইরে, তারা আর্টস, আইটিআই বা এমবিএ বেছে নেয়। ভাবা হয়, ডিগ্রি কমপ্লিট করলেই ভালো স্যালারির চাকরি পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তব? আমাদের অর্থনীতির পিছনে ১০% মানুষ ৯০% ইকোনমি ধরে রেখেছে, বাকি ৯০% মানুষ মাসিক ২৫,০০০ টাকার কম আয় করে। লিটারেসি রেট ৭৪%, কিন্তু কোকাকোলার মতো কোম্পানি ভারতে ৪০০০ কোটি টাকা আয় করে, অথচ যুবকরা ১০,০০০ টাকার চাকরি পাচ্ছে না। কারণ? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
ভারতে এমবিবিএস এবং বিডিএস সিট মোট ১.৪ লক্ষ, কিন্তু নিটে ২০.৮ লক্ষ ফর্ম ফিলাপ হয়। ২০২৫ সালে মোট এমবিবিএস সিট ১,১৮,১৩৭ (এনএমসি), কিন্তু আবেদনকারী প্রায় ২০ লক্ষ। ডাক্তারের দরকার আছে, প্রতিভা আছে, নেই শুধু সিট। এর মধ্যে অর্ধেক সরকারি, অর্ধেক প্রাইভেট। প্রাইভেটে ডাক্তার হতে খরচ ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা। বিটেকে প্রাইভেটে ৮ লক্ষ টাকা। যেখানে ৯০% মানুষের আয় ২৫,০০০ এর কম, সেখানে মধ্যবিত্ত কীভাবে এফোর্ড করবে? ফলে যাদের টাকা নেই, তারা গ্র্যাজুয়েশন করে সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করে। গুজরাতে ২০২৫ সালে ১০ জনের চাকরির জন্য ১ লক্ষ মানুষ এসেছে, ধাক্কাধাক্কি থেকে মারপিট হয়েছে।
আজ শিক্ষিত যুবকরা বিএ পাস করে চায়ের দোকান খুলছে, এমবিএ করে মোহর দোকান দিচ্ছে। সরকার বলছে চাকরি হবে, কিন্তু ফর্ম বেরোচ্ছে না। প্রাইভেটাইজেশনের ফলে হাজার হাজার সরকারি কর্মী চাকরি হারাচ্ছে। রাজ্যে ঘুষ দিয়ে চাকরি বিক্রি হচ্ছে। ২০২৫ সালে পাটনায় পরীক্ষায় দুর্নীতির প্রতিবাদে হাজার যুবক রাস্তায় নেমেছে। ফর্ম ঘোষণা হলে মাস কেটে যায়, পরীক্ষা লিক হয়, রেজাল্ট বছর কেটে যায়। ইন্টারভিউর আগেই চাকরি বিক্রি হয়ে যায়। কোর্ট কেসে জীবনের অর্ধেক চলে যায়।
কলেজ এবং সরকার জানে, ছাত্ররা আসছে ডিগ্রির জন্য, চাকরির জন্য নয়। আজ এআই, মেশিন লার্নিং, ডিজিটাল মার্কেটিং শিখে লক্ষ লক্ষ আয় করছে কেউ কেউ, কিন্তু স্কুল-কলেজ ১০০ বছরের পুরনো সিলাবাস পড়াচ্ছে। আইআইটিতে পুরনো মেশিনে শেখানো হচ্ছে, যা ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার হয় না। গ্রামে কম্পিউটার নেই, ৯০% কলেজে ইন্টার্নশিপ নেই। ইন্ডাস্ট্রি চায় স্কিল, কিন্তু কলেজ শেখায় না। প্রফেসরদের ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স নেই। আমেরিকায় মার্ক জুকারবার্গ লেকচার দেয়, ভারতে আম্বানি-আদানি নয়।
সময়ের সাথে টেকনোলজি ইভলভ হচ্ছে। এআই চলে এসেছে, যা মানুষের কাজ রিপ্লেস করছে। ২০২৫ সালে পিডব্লিউসির রিপোর্ট অনুসারে, এআই জবস বারোমিটার বলছে এআই মানুষকে আরও মূল্যবান করবে, কিন্তু অটোমেটেবল জবসে চ্যালেঞ্জ। ভারতে এআই সেক্টর ২০২৭ সালে ২.৩ মিলিয়ন জব ক্রিয়েট করবে, কিন্তু ট্যালেন্ট পুল শুধু ১ মিলিয়ন। ন্যাসকমের প্রজেকশন: ২০২৫ সালে ৪০০,০০০ নতুন জব এআইতে। কিন্তু কলেজ এআই শেখায় না, এমনকি সিভি বানানো শেখায় না। আমি যখন কন্টেন্ট রাইটার হায়ার করি, ৯০% মেইল ঠিক লেখে না।
টুইটারে (এক্স) ভারতীয় কর্মী মাত্র ৮০ জন, কোকাকোলায় ২৫,০০০। এমএনসি-তে হায়ারিং বন্ধ, স্টার্টআপ বন্ধ হচ্ছে। বেকারত্ব ৩ কোটি ছাড়িয়েছে, ২০২৮ সালে ৪৫ কোটি (ইকোনমিক টাইমস)। এর ফলে আন্ডার-এমপ্লয়মেন্ট: পিএইচডি করে পিয়নের চাকরি। যুবকরা মনে করে গভর্নমেন্ট জব পেলেই সাকসেস। বিহারে আইএএস ক্র্যাক করলে গ্রামে অর্কেস্ট্রা। কিন্তু গভর্নমেন্ট জবে লটারি জেতার চান্স বেশি। সরকার প্রতিদিন ২৭,০০০ চাকরি দিলেও ১১ বছর লাগবে সবাইকে দিতে।
পপুলেশন ১% বাড়ছে, স্বাধীনতার পর থেকে সরকারি চাকরির থেকে বেশি শিশু জন্মেছে। চীনের মতো সমস্যা। রুরাল এলাকায় ইন্ডাস্ট্রি গ্যাপ। সমস্যা এখানে শেষ নয়। সমাধান? এডুকেশন সিস্টেম চেঞ্জ: এনইপি ২০২৫-এ ৫+৩+৩+৪ স্ট্রাকচার, ভোকেশনাল এডুকেশন ৫০% লার্নার্সে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার বদল, সিলাবাস আপডেট। স্কিল ফোকাস: এআই, এমএল। ইন্ডাস্ট্রি-এডুকেশন লিঙ্ক। সরকারের দায়: ভ্যাকেন্সি ফিল, স্কিল ইন্ডিয়া লার্জ স্কেল। কর্পোরেট প্রমোট, রুরাল ডেভেলপমেন্ট। ঐতিহাসিক উদাহরণ: নেহরুর সময় ইন্ডাস্ট্রি সেটআপ, এলআইসি, ব্যাঙ্ক ন্যাশনালাইজেশন—লক্ষ লক্ষ জব। হোয়াইট রেভলিউশন (১৯৭০): অপারেশন ফ্লাড, দুধ উৎপাদন বাড়িয়ে লক্ষ লক্ষ জব ক্রিয়েট। হায়দ্রাবাদ আইটি হাব সরকারের ভূমিকায়। কাল বিশ্বগুরু হতে হলে আজ গুরুকুল এবং বিদ্যার্থীকে নতুন করে তৈরি করতে হবে।